জীবনানন্দ দাশের ১০০+ উক্তি, বাণী ও কবিতা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কবিতার মূল উপজীব্য ছিল প্রকৃতি, নিঃসঙ্গতা, মৃত্যু ও সময়। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কিছু হল “বনলতা সেন”, “রূপসী বাংলা” ও “মহা পৃথিবী”। তিনি ছিলেন নির্জনচেতা, ভাবুক ও নিঃশব্দের কবি। বাংলা সাহিত্যে উনি অনেক অবদান রেখে গেছেন। আপনারা চায়ের জীবনানন্দ দাশের উক্তি, বাণী এবং কবিতা সমগ্র অনুসন্ধান করে চলেছেন তারা আমাদের আজকের আর্টিকেলটি থেকে জীবনানন্দ দাশের উক্তি, বাণী ও কবিতা সমগ্র সংগ্রহ করুন।
বাংলা সাহিত্যপ্রেমি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যারা জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রেমে পড়েন নি। জীবনানন্দ দাশের শুধু কবিতা নয় বরং উনার উক্তি এবং বাণী ও অনেক জনপ্রিয়। তাই জীবনানন্দ দাশ প্রেমিক যারা রয়েছেন তাদের জন্য আমাদের আজকের আর্টিকেলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনানন্দ দাশের উক্তি
১#
প্রেম ধীরে মুছে যায়,
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?
২#
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না
খুঁজি না।
৩ #
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!
৪#
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
৫#
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
৬#
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
৭#
আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা
বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।
৮#
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলাম- ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়-
পঁচিশ বছর পরে।’
৯#
থমথমে রাত,- আমার পাশে বসল অতিথি,-
বললে,- আমি অতীত ক্ষুধা,-তোমার অতীত স্মৃতি!
১০#
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে
১১#
“কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ,
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।”
১২#
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! কুড়ি বছর পরে”
১৩#
“আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।”
১৪#
“কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।”
১৫#
যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা”
১৬#
“শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে
বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–
পঁচিশ বছর পরে!”
১৭#
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।”
১৮#
“সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।”
১৯#
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
২০#
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়, আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’পর।
এই বর্তমান,- তার দু’পায়ের দাগে
মুছে যায় পৃথিবীর’পর
একদিন হয়েছে যা – তার রেখা,- ধূলার অক্ষর!
- সে-আগুন জ্ব’লে যায়
সে-আগুন জ্বলে’ যায়
সে-আগুন জ্ব’লে যায় দহেনাকো কিছু।
নিমীল আগুনে ওই আমার হৃদয়
মৃত এক সারসের মতো। - কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে: - কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?
তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-
আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত
সূর্যকে সরায়ে দিয়ে। - সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তারে ফেলেছে সে মুছে অবহেলা! - তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো; অথবা রক্তের পথে
পৃথিবীর ধূলির ভিতরে
জানো নাকো আজও কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে; - আমার এমন কাছে — আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে
আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে — প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে। - আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, - মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুনের — ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা। - তোমার মাথার চুলে কেবলি রাত্রির মতো চুল
তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল
রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে
ধ’রে আছে। - যেইখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রান
বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান!-
তুমি সেইখানে! - তাদের মাটির গল্প—তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি—
তুমি জানো—এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি! - মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম
তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো
বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম। - হৃদয় আছে ব’লেই মানুষ, দ্যাখো, কেমন বিচলিত হ’য়ে
বোনভায়েকে খুন ক’রে সেই রক্ত দেখে আঁশটে হৃদয়ে
জেগে উঠে ইতিহাসের অধম স্থূলতাকে
ঘুচিয়ে দিতে জ্ঞানপ্রতিভা আকাশ প্রেম নক্ষত্রকে ডাকে।
জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তি
- সমস্ত সন্দেহ থেকে হৃদয়কে সরিয়ে এবার
শান্ত স্থির পরিষ্কার করে
চেয়ে দেখি মাছরাঙা সূর্য নিভে গেছে;
অন্য প্রেমিককে পাবে অন্য এক ভোরে। - মনে হয় শুধু আমি,- আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে- কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো- আধো কথা! - শুধু তার ঘন কালো চুল
সেই আবহমান রাত্রি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে রয়েছে
কোনো এক দূর, ভালো দ্বীপের মতো
যেখানে জাগ্রত পাখিদের প্রেম
ধূসর সমুদ্রকে জাগাতে পারে না আর। - সুদীর্ঘকাল তারার আলো মোমের বাতির দিকে
তাকিয়েছিল দুজন ওরাঃ শান্ত কক্ষে নীল জানালার পাশে
কাছাকাছি দুটো তারাঃ আলোকবর্ষ অনেক আলোকবর্ষ গেলে পরে
কাছে কাছে থেকে তারা রবে কি প্রবাসে?
এই তারাটির আলো গিয়ে পড়বে না কি অপর তারার বুকে
মনের গভীরতম সুখে-সমস্ত অসুখে? - কোন্-এক অন্ধকার লাইব্রেরির নিস্তব্ধ হলুদ পাণ্ডুলিপির মতো
দেখলাম তাকেঃ
শ্রাবণের রৌদ্রে রেবা নদীর মতো ছিল যে এক দিন; - চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি! - শোনা যায় — মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে — - তুমি এক! তোমারে কে ভালোবাসে! – তোমারে কি কেউ
বুকে ক’রে রাখে!
জলের আবেগে তুমি চ’লে যাও,-
জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ ধূ জল তোমারে যে ডাকে! - আমরা আজও বহন ক’রে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল
লুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎসনা… প্রেম নিভিয়ে দিলাম, প্রিয়। - যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে-আরো নীল-আরো নীল হয়ে
আমি যে দেখিতে চাই; - আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে। - শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধ’রে
আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে
দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; - ভোরের বেলার মাঠ প্রান্তর নীলকন্ঠ পাখি
দুপুরবেলার আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা,
সারাটি দিন মীনরৌদ্রমুখর জলের স্বর,-
অনবসিত বাহির-ঘরের ঘরণীর এই সীমা। - নক্ষত্রের রাতের আঁধারে
বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে
পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী
রাঙা মেঘ— হলুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি;
অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো; - পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
জীবনানন্দ দাশের বাণী
- স্ট্রেচারের ‘পরে শুয়ে কুয়াশা ঘিরিছে বুঝি তোমার দু-চোখঃ
ভয় নেই, মৃত্যু নয়, কোনো এক অপদার্থ অন্যায় আলোকঃ - অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
- অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা
অখণ্ড অনন্তে অন্তৰ্হিত হ’য়ে গেছে;
কেউ নেই, কিছু নেই— সূর্য নিভে গেছে। - মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে। - আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস
কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি
সেই শিথিলতা নও, - প্রেমের প্রয়াণ? তবু— এই শেষ অনিমেষ পথে
দেখেছে সে কোনো এক মহীয়সী আর তার শিশু;
দু-জনেই মৃত।
অথবা কেউ কি নেই!
ওইখানে কেউ নেই।
- সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিল
ততোধিক অসুস্থ সময়ে
আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়। - আজকে রাতে তোমায় কাছে পেলে কথা
বলা যেতো; চারি দিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র কাশ হাওয়ার প্রান্তর। - প্রেমের প্রেরণা নেই– শুধু নির্ঝরিত শ্বাস
পণ্যজাত শরীরের মৃত্যু-ম্লান পণ্য ভালোবেসে; - সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; - যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে –রাতে – নিরুদ্দেশে,
তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়! - তোমার বিনুনি খুলে,- হেঁট হয়ে,- পা তোমার থুয়ে,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে,- তোমার জলের স্বরে স্বরে
রয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে,- নীল পৃথিবীর’পরে! - রয়েছি সবুজ মাঠে- ঘাসে-
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে! – সে এক বিস্ময় - একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে। - নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে,
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত। - ছেড়ে দিয়ে উত্তরের বাতাসের প্রাণে
জন্মেছে তোমার ডানা-জেগেছে হৃদয়;
সহস্র শতাব্দী-গিঁট কাটায়েছি পথ আর ঘরের আঘ্রাণে–
আনন্দের পাই নিকো তবু পরিচয়; - এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;
কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন; - এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে
নির্জন খেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা - একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; – আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে! - ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে
চ’লে যাই;- কোন এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে?
পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে
আরো আকাশের দিকে,- অন্ধকারে,- অন্য কারো আকাশের থেকে!
জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত বানী
- ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের— বেদনার আমরা সন্তান? - যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।
- সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে! - তুমি রয়ে যাবে,- তবু,-অপেক্ষায় রয় না সময়
কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে! - আমার এ- গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে,-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-
তবুও হৃদয়ে গান আসে! - মেঘের দুপুর ভাসে— সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন
মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে; - জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে! - এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে
পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল:
প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়—
অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল। - মরণের হাত ধ’রে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?
- আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি
আমার বুকের’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি! - তবুও সবই ঠিক হয়েছে; কবের আদি পৃথিবী থেকে তুমি
কত গ্লানি রক্ত আঁধার বিহ্বলতার থেকে
চলেছ আজও তিলধারণের মতন পটভূমি
দান না ক’রে–নিজেরই গালে সে তিলবিন্দু রেখে - রাত যেন লেবুর ফুলের মতো নক্ষত্রের গন্ধ দিয়ে ঘেরা
শান্ত সব প্রতিবিম্ব –কবেকার জীবনের এই সব বেদনার স্তর। - জানি নদী নীল সাগরও দু-দণ্ডে শুকায়
চিতায় শরীর ফেলে রেখে মনও কোথায় যায়,
তোমার আমার ফুরিয়ে যাবার সময় তবু নেই
জন্মে জন্মে–তবুও জন্মে জন্মে ভালোবেসে। - রাত্রি আসে–রাত্রি শেষ হয়ে গেলে আলো;
আলো আরো মৃদু হলে তার তার চেয়ে বেশি
স্নিগ্ধ অন্ধকার সব–আকাঙ্ক্ষিত মেয়েটির হাতের মতন
কাছে এসে সংবরণ ক’রে তবু, যেন নেপথ্যের
ওপারের থেকে তার কথা বলে। - চিলের ডানার থেকে ঠিকরিয়ে রোদ
চুমোর মতন চুপে মানুষের চোখে এসে পড়ে;
শত টুকরোর মতো ভেঙে সূর্য ক্রমে আরও স্থির-
স্থিরতর হতে চায় নদীর ভিতরে। - কে আমারে ব্যথা দেছে,- কে বা ভালোবাসে,-
সব ভুলে,- শুধু মোর দেহের তালাশে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ মাটির’পরে
আসিব কি নেমে!
পথে পথে,- থেমে- থেমে- থেমে
খুঁজিব কি তারে,-
এখানের আলোয় -আঁধারে
যেইজন বেঁধেছিল বাসা! - এসো রাত্রি, অজানার সহোদরা তুমি,
মুমূর্ষু আলোর ভীষণতাকে তোমার শান্তি-নিঃশব্দতার ভিতর
গ্রহণ করবার জন্য
শোনো পৃথিবী, এই রাত্রির শীত, সফল বিসরণ;
এসো মৃত্যু, রাত্রির সহোদরা তুমি,
সময়ের এই অসৎ স্বাক্ষরিত অস্পষ্টতাকে নিঃশেষ করবার জন্যে। - ওইখানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ। - পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু
এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান। - যাহারা কিছুই সৃষ্টি করে নাই তাহাদের অবিকার মন
শৃঙ্খলায় জেগে উঠে কাজ করে— রাত্রে ঘুমায়
পরিচিত স্মৃতির মতন। - আমাদের অবসর বেশি নয়, – ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ – অবসাদ-
আমাদের ডেকে লয়,- তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা – অবসন্ন হাত। - মেঘের ফোঁটার মতো স্বচ্ছ, গড়ানে;
সুবাতাস কেটে তা’রা পালকের পাখি তবু;
ওরা এলে সহসা রোদের পথে অনন্ত পারুলে
ইস্পাতের সূচীমুখ ফুটে ওঠে ওদের কাঁধের ’পরে,
নীলিমার তলে; - সন্ধ্যার নদীর জলে এক ভিড় হাঁস ওই— একা;
এখানে পেল না কিছু; করুণ পাখায়
তাই তা’রা চলে যায় শাদা, নিঃসহায়।
- গভীর নিসর্গ সাড়া দিয়ে শ্রুতি বিস্মৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে দিতো তবু
একটি মানুষ কাছে পেলে;
জীবনানন্দ দাশের কবিতা
বনলতা সেন
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
শঙ্খমালা
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা:
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে-আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার;
এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
অন্ধকার
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে—
কোনোদিন আর জাগবো না জেনে
কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর—
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—
জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে,
শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি!
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন।
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর;
তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—
কোনোদিন জাগবো না জেনে—
কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।