মা দিবসে মাকে নিয়ে ছড়া ও কবিতা। Mother’s Day poem.

মা কথাটি ছোট কিন্তু এর অর্থ সমুদ্র সমান, এক আকাশ সমান। আজ আমাদের যে বিশাল বিশাল অর্জন, এই সকল অর্জনের পিছনে যে পরিশ্রমী যোদ্ধা লুকিয়ে আছে তিনি হচ্ছেন মা। যেদিন আমরা প্রতিটা দিনই মা দিবস হিসেবে পালন করতে পারব, যেদিন আর আলাদা করে মা দিবস পালন করতে হবে না, সেদিনই আমরা প্রকৃত সন্তান হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারব। কারণ প্রতিটি দিনই মা আমাদের জন্য সমানতালে নিরলস পরিশ্রম করে যান। আজকের এই মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করছি। সকল মায়েদের জানাই মা দিবসের শুভেচ্ছা।

সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ আপনারা যারা মা দিবস নিয়ে বা Mother’s Day নিয়ে কবিতা অনুসন্ধান করে চলেছেন তাদের জন্য আমাদের আজকের আর্টিকেলে মা দিবস নিয়ে কিছু সুদর সুন্দর কবিতা নিয়ে আসা হয়েছে। আপনারা এই কবিতাগুলো সংগ্রহ করুন এবং মা দিবসের দিন আবৃত্তি করে মায়ের কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করুন। এই কবিতাগুলো আপনারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ও শেয়ার করতে পারেন।

মায়ের পাওয়া

আমার মায়ের কাছে আমি
বড় মানিক-ধন
মা যে আমার এই পৃথিবীর
সেরা আপনজন।
সুখের কথা দুঃখের কথা
সব বলা যায় মাকে
তার দোয়াতেই সৃষ্টিকর্তা
সুস্থ শরীর রাখে।

নামাজ পড়ে কান্না করে
খোদার কাছে চাওয়া
সন্তানেরা ভালো থাকুক
এটাই মায়ের পাওয়া।

মায়ের পাগল

শিশুরা হয় মায়ের পাগল
থাকে পিছুপিছু
মা ছাড়া এই দুনিয়াতে
দামি নেই আর কিছু।
মায়ের কাছে শেখে বুলি
মায়ের হাতে খাওয়া
মায়ের কোলে মজার ঘুমে
পরির দেশে যাওয়া।
মাকে ছাড়া কিছুই হয় না
শিশু-কিশোর বেলা
বড় হলেও সাথে থাকে
মায়ের দোয়া মেলা।

 

মা

মা মানে তো স্বর্গ; এমন
দুঃখ যেথায় নেই,
মা মানে তো ঘুম না এলে; বাবা
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?

মা মানে তো, বকাঝকা
রাগ দেখানো অনেক,
‘এত্ত রাতে ফিরলি বাড়ি
কোথায় ছিলি, জনৈক?’

মা মানে তো আদর-সোহাগ, আর
মিষ্টি করে ডাকা,
কেউ বাড়িতে এলেই দেখান
‘এই যে আমার খোকা।’

মা মানে তো, দূরে থাকা
কষ্ট অনেক হবে,
বলতে থাকা ডেইলি ফোনে
খোকা, বাড়ি আসবি কবে?

মা মানে তো সবার সেরা;
সবার আপন আলয়
মাকে ঘিরে স্বপ্ন, ছবি
হাজার ভালোবাসায়।

 

মিথ্যাবাদী মা

“এতোটা দিন পেরিয়ে আজো মায়ের জন্য কাঁদি

কারণ আমার মা যে ছিলো ভীষণ মিথ্যাবাদী

বাবা যেদিন মারা গেলেন আমরা হলাম একা

সেদিন থেকেই বাঁক নিয়েছে মায়ের কপাল রেখা।

মা বলতো বাবা নাকি তারার ভিড়ে আছে

লেখাপড়া করি যদি নেমে আসবে কাছে।

তারায় তারায় বাবা খুঁজি – তারার ছড়াছড়ি

আমার মায়ের মিথ্যা বলার প্রথম হাতেখড়ি।

পাড়া পড়শী বলল এসে এই বয়সেই রাঢ়ি

একা একা এতোটা পথ কেমনে দিবে পাড়ি।

ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে করো আবার

মা বললো ওসব শুনলে ঘেন্না লাগে আমার।

একা কেনো? খোকন আছে, বিয়ের কি দরকার

ওটা ছিলো আমার মায়ের চরম মিথ্যাচার।

রাত্রি জাগে সেলাই মেশিন, চোখের কোণে কালি

নতুন জামায় ঘর ভরে যায়, মায়ের জামায় তালি।

ঢুলু ঢুলু ঘুমের চোখে সুই ফোটে মা-র হাতে

আমি বলি শোও তো এবার, কী কাজ এতো রাতে?

মা বলতো ঘুম আসেনা, শুয়ে কী লাভ বল

ওটা ছিলো আমার মায়ের মিথ্যা কথার ছল।

স্কুল থেকে নিতে আসা গাড়ী ঘোড়ার চাপে

আমার জন্য দাঁড়ানো মা কড়া রোদের তাপে।

ঘামে মায়ের দম ফেটে যায়, দু চোখ ভরা ঝিম

ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে আমায় দিতো আইসক্রীম

মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতাম একটা নাও

মলিন হেসে মা বলত- খাও তো বাবা খাও।

আমার আবার গলা ব্যথা ঠান্ডা খাওয়া মানা

ওটা ছিলো আমার মায়ের নিঠুর মিথ্যাপনা।

বড় হয়ে চাকুরী নিয়ে বড় শহরে আসি

টুকটুকে বউ ঘরে আমার বউকে ভালোবাসি।

পশ এলাকায় বাসা নিয়ে ডেকোরেটর ধরে

সাজিয়ে নিলাম মনের মতো অত্যাধুনিক করে।

মা তখনো মফস্বলে কুশিয়ারার ঢালে

লোডশেডিং এর অন্ধকারে সন্ধ্যা বাতি জ্বালে।

নিয়ন বাতির ঢাকা শহর আলোয় ঝলমল

মাকে বলি গঞ্জ ছেড়ে এবার ঢাকায় চল।

মা বললো এই তো ভালো খোলা মেলা হাওয়া

কেনো আবার তোদের ওই ভিড়ের মধ্যে যাওয়া

বদ্ধ ঘরে থাকলে আমার হাপানি ভাব হয়

ওটা ছিলো আমার মায়ের মিথ্যা অভিনয়।

তারপর আমি আরো বড় স্টেটস এ অভিবাসী

বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ সুনাম রাশি রাশি।

দায়িত্বশীল পদে আমার কাজের অন্ত নাই

মায়ের খবর নিব এমন সময় কমই পাই।

মা বিছানায় একলা পড়া খবর এলো শেষে

এমন অসুখ হলো যার চিকিৎসা নেই দেশে।

উড়ে গেলাম মায়ের কাছে অনেক দূরের পথ

পায়ে পড়ি বলি মাকে এবার ফিরাও মত।

একা একা গঞ্জে পড়ে কী সুখ তোমার বলো

আমার সঙ্গে এবার তুমি এ্যামেরিকা চলো।

এসব অসুখ এ্যামেরিকায় কোন ব্যাপার নয়

সাত দিনের চিকিৎসাতেই সমূল নিরাময়।

কষ্ট হাসি মুখে এনে বলল আমার মা

প্লেনে আমার চড়া বারণ তুই কি জানিস না?

আমার কিছু হয়নি তেমন ভাবছিস অযথা।

ওটাই ছিলো আমার মায়ের শেষ মিথ্যা কথা।

কদিন পরেই মারা গেলো নিঠুর মিথ্যাবাদী

মিথ্যাবাদী মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি।”

কত ভালবাসি

             – কামিনী রায়

জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-

“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”

“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।

“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।

“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”

মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”

“তবু কতখানি, বল।”

“যতখানি ধরে

তোমার মায়ের বুকে।”

“নহে তার পরে?”

“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”

“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!

 

পল্লী জননী

                  – জসীম উদ্‌দীন

রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,

নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,

করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।

শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,

তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।

ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,

এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?

ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,

শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।

ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,

ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?”

মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”

ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?”

পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,

পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।

নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,

ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।

ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর।

কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।

বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,

বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।

চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,

দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।

যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,

বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।

ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,

করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?

আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া

এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”

মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,

ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।

“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,

রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।

খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,

ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”

ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,

বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,

কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।

সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,

হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।

এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,

ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে?

কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,

ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।

আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,

বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।

করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;

উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।

আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,

ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।

ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,

মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর।

পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,

কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।

ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে,

ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।

সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।

পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,

আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।

নোলক

           – আল মাহমুদ

আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে

হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।

নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তুমার কাছে?

-হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।

বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে

শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।

জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক

সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক

বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,

আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরেক যেতে চাই।

কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন

আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।

সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি না তো।

ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো-

বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক।

হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।

এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা

আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

কোথায় ছিলাম আমি

                           -কাজী নজরুল ইসলাম

মা গো! আমায় বলতে পারিস কোথায়

ছিলাম আমি-

কোন্ না-জানা দেশ থেকে তোর

কোলে এলাম নামি?

আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি মেলে

চাঁদকে বুঝি বলতিস্-ঐ ঘর-ছাড়া মোর

ছেলে?

শুকতারাকে বলতিস্ কি, আয় রে নেমে আয়-

তোর রূপ যে মায়ের

কোলে বেশি শোভা পায়।

কাজলা দিঘির নাইতে গিয়ে পদ্মফুলের

মুখে

দেখ্তিস কি আমার ছায়া, উঠ্ত কাঁদন

বুকে?

গাঙে যখন বান আসত, জানত না মা কেউ-

তোর বুকে কি আসতাম আমি হয়ে স্নেহের

ঢেউ?

লুকোচুরি

                        -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি যদি দুষ্টুমি ক’রে

চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,

ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে

কচি পাতায় করি লুটোপুটি,

তবে তুমি আমার কাছে হারো,

তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।

তুমি ডাক, “খোকা কোথায় ওরে।’

আমি শুধু হাসি চুপটি করে।

যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে

সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।

স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে

আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;

এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,

দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে —

তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে

তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।

দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে

বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,

গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে

পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,

আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি

দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি —

তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে

তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।

সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে

যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে

তখন আমি ফুলের খেলা খেলে

টুপ্ করে মা, পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।

আবার আমি তোমার খোকা হব,

“গল্প বলো’ তোমায় গিয়ে কব।

তুমি বলবে, “দুষ্টু, ছিলি কোথা।’

আমি বলব, “বলব না সে কথা।’

খোকার গপ্‌প বলা

                           -কাজী নজরুল ইসলাম

মা ডেকে কন, ‘ খোকন-মণি! গপ্‌প তুমি জান?

কও তো দেখি বাপ!’

কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ

বললে খোকন, গপ্‌প জানি, জানি আমি গানও!’

ব’লেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল-

‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’

মা সে হেসে তখন

বলেন, ‘উহুঁ গান না, তুমি গপ্‌প বল খোকন!’

আঁকতে আঁকতে

                 -ফারুক নওয়াজ

আঁকাই আমার শখ;

আঁকতে বসে আঁকি যদি

একটি পাহাড়, একটি নদী

শাদা ডানায় উড়ে যাওয়া

ধবধবে এক বক-

শেষ হয়ে যায় আঁকা যখন

অবাক লাগে ভারী-

তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের

সবুজ রঙের শাড়ি।

মাতৃভক্তি

                      -কবি কালিদাস

বায়েজিদ বোস্তামী-

শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।

দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন,’বাছাধন,

বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন।

দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি,

বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।

মায়ের তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধকারে

ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।

জল ঢালি পিয়ালায়

সুপ্তা মাতার নয়ন শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।

ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিঁদ,

সেই ভরসায় পানি হাতে খাঁড়া রহিল যে বায়েজিদ।

পূর্ব গগন ফর্সা হইল,ডাকিয়া উঠিল পাখি,

জননী মেলিল আঁখি।

দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে

পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।

সহসা পড়িল মনে,

গভীর রাতে পিপাসায় পানি চেয়েছিল বাছাধনে।

কহিল মা, মরি মরি!

বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি

দাঁড়াইয়া আছ? ঘুমাওনি আজ?’ চোখে এল জল ভরি।

পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি।

কহিল জননী,’নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,

খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপূজ্য হও।

পুত্র গরবে গর্বিত বুকে,খোদা, স্মরি তব নাম,

তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।’

বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা

জগৎ-বন্দ্য জ্ঞানগুরুদের বায়েজিদ একজনা।

মা

                       -কাজী নজরুল ইসলাম

যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন আহা

একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,

মায়ের মতন এত

আদর সোহাগ সে তো

আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!

হেরিলে মায়ের মুখ

দূরে যায় সব দুখ,

মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,

মায়ের শীতল কোলে

সকল যাতনা ভোলে

কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

কত করি উৎপাত

আবদার দিন রাত,

সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!

আমাদের মুখ চেয়ে

নিজে র’ন নাহি খেয়ে,

শত দোষী তবু মা তো তাজে না।

ছিনু খোকা এতটুকু,

একটুতে ছোট বুক

যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন

বুকে করে নিশিদিন

আরাম-বিরাম-হীন

দোলা দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো খোকন?’

আহা সে কতই রাতি

শিয়রে জ্বালায়ে বাতি

একটু আসুখ হলে জাগেন মাতা,

সব-কিছু ভুলে গিয়ে

কেবল আমায়ের নিয়ে

কত আকুলতা যেন জাগন্মাতা।

যখন জন্ম নিনু

কত আসহায় ছিনু,

কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু,

ওঠা বসা দূরে থাক-

মুখে নাহি ছিল বাক,

চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছু পিছু।

তখন সে মা আমার

চুমু খেয়ে বারবার

চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়

বুঝিয়া নিতেন যত

আমার কি ব্যথা হোতো,

বল কে ওমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।

তারপর কত দুখে

আমারে ধরিয়া বুকে

করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়,

কত না সে সুন্দর

এ দেহে এ অন্তর

সব মোর ভাই বোন হেথা যত পড়।

পাঠশালা হ’তে যবে

ঘরে ফিরি যাব সবে,

কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে মাতা,

খাবার ধরিয়া মুখে

শুধাবেন কত সুখে

কত আজ লেখা হোলো, পড়া কত পাতা?’

পড়া লেখা ভাল হ’লে

দেখেছ সে কত ছলে

ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।

বলে, ‘মোর খোকামনি!

হীরা-মানিকের খনি,

এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে।

গা’টি গরম হলে

মা সে চোখের জলে

ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে বল’।

কত দেবতার ‘থানে’

পীরে মা মানত মানে-

মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।

যখন ঘুমায়ে থাকি

জাগে রে কাহার আঁখি

আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।

তাই কত ছড়া গানে

ঘুম-পাড়ানীরে আনে,

বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।

দিবানিশি ভাবনা

কিসে ক্লেশ পাব না,

কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে;

বুক ভ’রে ওঠে মা’র

ছেলেরি গরবে তাঁর,

সব দুখ হয় মায়ের আশিসে।

আয় তবে ভাই বোন,

আয় সবে আয় শোন

গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;

মা’র বড় কেহ নাই-

কেউ নাই কেউ নাই!

নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *